শিল্প ও সাহিত্য

Mazibur Rahman, ঢাকা

1:39 AM, 15 March, 2021 LAST MODIFIED: 1:39 AM, 15 March, 2021

আসাদ মান্নান : সূর্যোদয়ের কবি

আমার জানা নেই, কবির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আকার-বিন্যাস কিংবা স্থাপত্যধর্মিতার কোন যোগ রয়েছে কিনা কিন্তু ধরা যাক, বিনয় মজুমদারের কথা মনে পড়লেই মনোচোখে ভেসে ওঠে পয়ার-মহাপয়ার-অক্ষরবৃত্তের সারিবদ্ধ দৃশ্যমানতা। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ভাবতেই বনলতা সেনের স্থাপত্যিক সেই অবিস্মরণীয় স্তবক আর তার সূত্রে একে-একে আসতে থাকে রূপসী বাংলা’র পর-পর সাজানো সুদৃশ্য ভবনের মত সনেটগুলো। অথচ তাঁর ভিন্ন কাঠামোবিন্যাসের কবিতার সংখ্যা বড় কম নয়। সব কবিই হয়তো এমনভাবে স্মরণযোগ্য নয়Ñ যেহেতু কবিতা মূলত শব্দনির্ভর, কবিতার ক্ষেত্রে আকারের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু বিবেচ্য হতে পারে, কিন্তু কোন-কোন কবির ব্যক্তিত্বের সমান্তরালে তাঁর কবিতার স্থাপত্যিক সৌন্দর্যের যে একটি সূত্রিতা থাকতে পারে সেটা কবি আসাদ মান্নানের কবিতার একজন পাঠক হিসেবে অন্তত আমার পক্ষে বলা সম্ভব। কেবল পাঠক বলি কেন, আমি তাঁর কবিতার আদি পাঠকদের মধ্যেও অন্যতম। আমরা যখন চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র তখনই তাঁর কবিতা বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে বিস্তর ছাপা হচ্ছে। আর, আমাদের ¯œাতক পর্যায়ে সারা বাংলাদেশের কথা তত আমাদের সাধ্যের সীমানায় থাকে না, তবে চট্টগ্রাম শহরে কবিতার নায়ক বলতে যদি কাউকে বিবেচনা করা হতো আমরা জানতাম তিনি অবশ্যই আসাদ মান্নান। কবিতার সাংগঠনিকতার মুহুর্মূহু তাঁর ব্যস্ততাযাপন নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয় কিন্তু তাঁর কাজ এবং কবিতার দুই রেখাই ছিল সমান্তরাল এবং সমানও। মনে পড়ে, চট্টগ্রামের ‘ফুলকি’-প্রাঙ্গণে এক অসাধারণ সন্ধ্যায় কবি আহসান হাবীবের সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে আমাদের কবিতামগ্ন ক্লান্তিহীনতা। চোখের সামনে দেখতে পেলাম স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করছেন আহসান হাবীব ‘আমি কোন আগন্তুক নই’, সম্ভবত তাঁর সেই পাঠ ছিল তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনার প্রত্যুত্তরও। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবার কথা ছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালের। কিন্তু সেদিনই এক দুর্ঘটনায় তাঁর ভ্রাতৃবধূ অগ্নিদগ্ধ হলে (পরে মৃত্যুবরণ করেন।) সভাপতিত্বের দায়িত্ব বর্তায় চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কবি আ. ফ. ম. সিরাজ-উদ-দউলা চৌধুরীর ওপর। সিরাজ স্যার আমাদের অনেকেরই শিক্ষক ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজে। মাঝে-মাঝে আমরা তাঁর কখনো কান্না কাব্যগ্রন্থেও ‘মধুমিতা সেন’ প্যারোডি-কবিতাটি আওড়াতাম যেটির উদ্বোধনী পংক্তিদ্বয় ছিল এরকমÑ “আমাদের কলেজের মধুমিতা সেন,/ এযাবত অনেকের মাথা খেয়েছেন।” কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা পাঠ করেন দারুণ এক ছন্দময় কবিতা। কবি রফিক আজাদ এবং বেলাল চৌধুরীও ছিলেন অনুষ্ঠানে। আয়োজক ‘কবিতা সমিতি’র কর্ণধার আসাদ মান্নানের একক উদ্যোগে এরকম একটি সফল আয়োজন তরুণ আমাদের মনে একটা গভীর প্রাণনার ছাপ রেখে যায়। একটি দীর্ঘ কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যাটিকে আরও আবেগার্ত করে তুলেছিলেন আসাদ মান্নান। তারপর যখন সৈয়দ বংশের ফুল কাব্যগ্রন্থটি আমাদের হাতে আসে, আমাদের মনে পড়ে কবি জীবনানন্দ দাশকে। মনে পড়ে, কারণ তিনিও দাশকবির মতন সনেট-রচয়িতা। তাঁর প্রায় সব কবিতাই ছন্দানুসারী। নিরেট গদ্যের কবিতা খুব কমই পাই তাঁর। সেই আদি আসাদ মান্নান পরবর্তীকালে তাঁর সেই পূর্ববিন্যাসের ধ্রুপদী-চরিত্রেই গাঁথা রয়ে যান। কতকাল আগে পাঠ করেছিলাম তাঁর কবিতা ‘সুন্দর দক্ষিণে থাকে’। বহুকাল আগে তাঁর কবিতা ‘সূর্যাস্তের উল্টোদিকে’ পাঠ করে আমরা জায়মান কবিবন্ধুরা বলাবলি করতাম, এর মানে হলো ‘সূর্যোদয়ের দিকে’। অনেককেই বলতে শুনি, সৈয়দ বংশের কবি ছদ্মনামে তাঁকে ডাকতে। এক অত্যাবেগসম্ভূত কাব্যের নির্মাতা হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করি আমরা। একই সঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের অকৃত্রিম অনুরাগী, কিন্তু নিজের কাব্যবোধ আর কাব্যচারিত্রটিকে ভাষা ও প্রকাশে উজ্জ্বল করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন কবি আসাদ মান্নান।
বাংলাদেশের কবিতায় এমন অনেক কবি আছেন যাঁদের আমি বলি জাতীয়তাবাদী। একজন কবির কাব্যোপকরণ অবশ্যই বিবিধই হয়ে থাকে। তথাপি কবির থাকে এক ধরনের নিজস্বতার অনুসৃতি, যে-শরণে তাঁর আত্মতৃপ্তি, যে-শরণে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য এবং যে-শরণে তাঁর বিশিষ্টতা। প্রবীণ-নবীন উভয়াংশ থেকেই ধারাবাহিকভাবে তাঁদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপনযোগ্য। যেমন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এবং আসাদ মান্নান। এঁদের কাব্যবোধের অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে অন্তত শেষোক্ত দু’জনের বেলায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা এসবের তাৎপর্য প্রকৃতই নতুন মাত্রিকতাসঞ্চারী। হ্যাঁ, বয়সে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র কাব্যকর্মে এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জাতিগত চেতনার প্রভাব যথেষ্ট এবং মোহাম্মদ রফিক ও মুহম্মদ নূরুুল হুদার কবিতার উল্লেখযোগ্য উপাদান বাঙালির জাতিতাত্ত্বিক বিষয়াবলি এবং আবশ্যিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু চারজনের শেষ দু’জন, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এবং আসাদ মান্নান মুক্তিযুদ্ধচেতনার তারুণ্যখচিত ও স্পর্ধিত উৎক্ষেপ। সেই উৎক্ষেপের আবার দুই রেখাÑ এক রেখায় প্রবলভাবে সমকালচেতন ও অতি বিক্ষুব্ধ আত্মার ধারক রুদ্র এবং অন্য রেখায় ঐতিহ্য ও প্রকৃতিচেতন নিমগ্নতার বাহক আসাদ মান্নান। দু’জনের সচেতনতার ধারাভিন্নতা দুইয়ের সমানুভূমিক উৎকলণ থেকে অনুভবযোগ্য। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র কবিতা থেকেÑ
“আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজও আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজও আমি তন্দ্রার ভেতরেÑ
এ-দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?”
এমন বিক্ষুব্ধ-স্পর্ধিত সত্তার পক্ষেই সম্ভব আরও চরমারোহে আত্মপ্রকাশÑ “ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।” প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আমাদের মনে পড়ে যায় আরেক সংক্ষুব্ধ সত্তার কবি রফিক আজাদকে যিনি ক্ষুধার্ত এবং ‘মানচিত্র’ উদরস্থ করবার তীব্র এষণায় তাড়িত। ক্ষোভের-দ্রোহের এমন চরমতার হেতু মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিচ্যুতি ও চেতনাবিরোধী সক্রিয়তার বিপরীতে কবির প্রায় রাজনৈতিক ধরনের উচ্চ-তার প্রকাশ। কবির কবিতাই তখন অলিখিত ম্যানিফেস্টো। আমাদের মনে পড়ে জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকা-ের পরিণামে চরাচরব্যাপী স্তব্ধতার আয়তনে পবিত্র বাণীর মতন উচ্চারিত হতে থাকে নির্মলেন্দু গুণের কবিতার পংক্তিমালা “আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি”। এই ক্ষোভ এই ক্রোধ এই দ্রোহের মর্ম অনুধাবন তাঁদের পক্ষেই সম্ভব যাঁদেরও রয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার নবচেতন বিন্যাস লক্ষ করা যাকÑ
“আমি এ বন্দুক কাঁধে সাতলক্ষ নক্ষত্রের ছায়ার ভেতর
পৃৃথিবীর সর্বশেষ কুমারীর চুলের খোঁপায় হেঁটে যাবো;
একেকটি বুলেট থেকে বের হবে সাতলক্ষ মানুষের ঘর
প্রত্যেক ঘরের মধ্যে জন্ম নেবে মুহাম্মদ সক্রেটিস যিশু
প্রত্যেক যিশুর বুকে বন্দুকের নলাঘাতে গোলাপ ফুটাব
প্রত্যেক গোলাপ থেকে জন্ম নেবে পৃথিবীর সর্বশেষ শিশু,
যে শিশু নিজেই হবে ঈশ^রের একমাত্র উত্তরাধিকারীÑ
মানবমনীষা জুড়ে এই নামে তৈরি হবে কবিতার বাড়ি।”
(‘আসাদ মান্নান’)



You have to login to comment this post. If You are registered then Login or Sign Up