আলোচনাটা শুরু করবো তুলনার জন্য শহীদুল জহিরের `সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো` উপন্যাসের উদাহরণ টেনে। স্বাধীনতা উত্তর কালের যে কয়েকজন উপন্যাসিক পাঠক সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছেন তার মধ্যে শহীদুল জহির একজন। `সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো` প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৫ সালে। প্রকাশের আগেই তিনি `জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা` উপন্যাসের মাধ্যমে সে সময়ে অনেকের মনোযোগ কেড়েছিলেন। তাই `সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো` প্রকাশের সময়ে তিনি আনকোরা অপরিচিত কোন লেখক ছিলেন না। সাথে সাথেই লেখাটা সাড়া ফেলেছিলো। আমরা যারা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম ও শিল্প সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিতাম, তাদের কথাবার্তাতে তিনি প্রায়ই উল্লেখিত হতেন। আজ ফিরে দেখা ও লেখাটা পুনরায় পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, এই উপন্যাসটা আমার পড়া সেরা উপন্যাসের একটা। বিশ্ব পর্যায়ের সেরা কাজগুলোর সমতুল্য। বর্তমানে যে সব বেষ্ট সেলার উপন্যাস বিশ্ব বাজারে বিক্রি হয় তার কিছু আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। শহীদুল জহিরের উপন্যাসটা তাদের সহজেই অতিক্রম করে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো যে শহীদুল জহির সাড়া ফেললেও যাকে বলা যায় ব্যাপক সাড়া তা ফেলতে পারেন নি। সেরা লেখক হিসাবে তার প্রতিষ্ঠা পেতে আরো প্রায় দশ-পনের বছর লেগে যায়। শহীদুল জহিরের সাথে প্রায়ই একই সময়ে বই প্রকাশ করেছিলেন এমন একজনের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভিন্ন রকম। তিনি প্রকাশ করেছিলেন ইংরেজিতে। নাম অরুন্ধতী রায়। উপন্যাসের নাম `গড অফ স্মল থিংগস`। প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে। প্রকাশের পরে তিনি বুকার পুরষ্কার পান। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। সাড়া ফেলে বাংলাদেশেও, যাকে বলা যায় ব্যাপক সাড়া। সে সময়ে পত্র পত্রিকাতে বইটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এমনকি মনে আছে টিভিতে সাহিত্য অনুষ্ঠানে বইটা নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। নীলক্ষেতের বই বাজারে পাইরেটেড কপি বিক্রি হওয়া শুরু হয়। বছর খানেক পরে বের হয় বাংলাতে অনুবাদ। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে একজন সেলেব্রিটিতে পরিণত হন।
আমি এই দুই সেরা কাজের পাশাপাশি তুলনা করে দেখালাম বোঝাতে যে, বাংলা সাহিত্যের সেরা কাজ ও বিশ্ব সাহিত্যের সেরা কাজ নিয়ে যে বাংলাদেশের ভিতরে যে প্রতিক্রিয়া ঘটে তার অনেক পার্থক্য আছে, যদিও মানের দিক থেকে তাদের খুব বেশি ব্যবধান হয়তো নেই। বরং শহীদুল জহিরেরটাই হয়তো বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য ছিলো। তাতে ছিলো মুক্তিযুদ্ধ, খুব কৌশলে শিল্পিতভাবে মিল ঘটানো হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাথে। তবু বাংলা সাহিত্যের সেরা কাজকে বিশ্ব সাহিত্যের এক সেরা কাজ, সহজেই দেশের ভিতরে প্রতিক্রিয়াতে হারিয়ে দিতে পেরেছিলো।
এই রকম প্রসঙ্গে যখন কারো সাথে কথা বলি তখন কিছু কিছু অদ্ভুত যুক্তির মুখোমুখি হই। যেমন কেউ হয়তো বলছেন যে বুকার পুরস্কারের মাধ্যমে অরুন্ধতী রায়ের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ঘটেছিলো। সে রকম প্রচার প্রচারণা চালানোর প্রতিষ্ঠান তো বাংলাদেশে নেই। এই পর্যবেক্ষণটা সত্যি হতে পারে কিন্তু প্রতিষ্ঠানের অভাব অরুন্ধতী রায়ের কাজের প্রচার বাংলাদেশের ভিতরে হবার ক্ষেত্রে বাধা হয় নি। বাংলাদেশের লেখক সমাজ ও তৎকালীন মিডিয়া নিজেরাই বইটার প্রচারে নেমেছিলো। প্রতিষ্ঠানের অভাব শুধু বাধা হয়েছিলো শহীদুল জহিরের ক্ষেত্রে। অরুন্ধতী রায়ের ক্ষেত্রে বিশ্ব মিডিয়ার প্রচারের প্রতিক্রিয়াতে ঘটেছিলো বাংলাদেশের মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া, তার ধারাবাহিকতাতে লেখক সমাজ। সেই প্রতিক্রিয়া শহীদুল জহিরকে নিজস্ব ভাষাতে পড়ার প্রতিক্রিয়ার চেয়ে শক্তিশালী হয়েছিলো। যারা শহীদুল জহিরকে সে সময়ে পড়েছিলেন তারা বুঝে উঠেন নি যে অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে যে রকম উচ্ছ্বাস, বাংলাদেশকে নিয়ে লিখিত হবার কারণে শহীদুল জহিরকে নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে উচ্ছ্বাস তার চেয়ে বেশি প্রাপ্য ছিলো।
আরেকটা অদ্ভুত কথা প্রচলিত আছে। তা হলো শিল্প সাহিত্যের কাজ ভালো না মন্দ তা মহাকালই মূল্যায়ন করবে। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে জগতে মহাকালের ধারণাটা জনপ্রিয় কিন্তু ভুল একটা ধারণা। কবিতার ক্ষেত্রে মহাকালের ধারণাটা কিছুটা তবুও চলে। কিন্তু উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশ্ব সাহিত্যের বড় কাজগুলো প্রকাশের প্রথম বছরই সাড়া ফেলে, এমনটাই দেখা যায়। কোনটা ভালো তা বোঝার জন্য মহাকালের অপেক্ষাতে বসে থাকা হয় না। এর মধ্যে হয়তো কয়েকটা সমকালে গুরুত্ব পাওয়ার পাশাপাশি কালোত্তীর্ণ হতে পারে। সমকালে গুরুত্ব পায়নি কিন্তু কালোত্তীর্ণ হয়েছে এমনটাই মনে হয় কম। এক্ষেত্রেও তাই মূলে আছে দ্বিচারিতা। যারা মহাকালের কথা বলেন তাদের কিন্তু সমকালে অরুন্ধতী রায়কে গ্রহণে আপত্তি হয়নি।
আমি এমনও শুনেছি যে শিল্পীর সব কাজ বিবেচনা করেই তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। এরকমটাও অরুন্ধতী রায়ের ক্ষেত্রে হয়নি। প্রথম কাজ প্রকাশের পরেই তাকে সাহিত্য বোদ্ধা সমাজের গ্রহণ করেছেন। তাই এক্ষেত্রেও দেখা গেছে দ্বিচারিতা। আর এই কথাটাও অদ্ভুত কারণ লেখা এখনো হয়নি, তেমন অজানা ভবিষ্যতের অপেক্ষাতে মূল্যায়ন ফেলে রাখার কোন যুক্তি নেই। অরুন্ধতী রায় তার প্রথম উপন্যাসের পরেরটা লিখেছেন প্রায় বিশ বছর পরে। খুব কম লোকই অন্যের সব লেখা পড়ে। ভেবে দেখুন আমি আপনি জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথের সব লেখা পড়েছি কিনা?
এই কথাগুলো আগেও অনেকে বলেছেন। `গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না` বলে তো একটা কথা প্রচলিত আছেই। কিন্তু আমার মনে হয় সমস্যাটা আরো গভীর। সমস্যা হলো সমস্যাটা আছে জেনেও সে অনুযায়ী যা করণীয় তা না করা। তাই সমালোচনা সমালোচনাতেই থেকে যায়। উত্তরণ হয় না।
খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে শিল্প সাহিত্যকে বাংলাদেশের মানুষ যে ভাবে ভোগ করে তার সাথে উপনিবেশিক আমলের সম্পর্ক আছে। উপনিবেশিক সময়ে বাংলাদেশ অন্য রাষ্ট্রের অধীনস্থ ছিলো। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো সাংস্কৃতিক আধিপত্য। এখনও তার ধারাবাহিকতাতে ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, স্পেনীয় ইত্যাদি ইউরোপীয় সাহিত্যকে অগ্রগণ্য মনে করা হয়, যা উপনিবেশিক আমলের প্রভাব তাতে সংশয় করার সুযোগ নেই। এতো সবাই জানেনই। কিন্তু জানা আর করনীয়তে পার্থক্য আছে, যার প্রতি আমি নজর দিতে বলবো।
You have to login to comment this post. If You are registered then Login or Sign Up